এ কারণে তাদের অনেকের ধারণা, তারবিয়া হচ্ছে- তত্ত্বীয় জ্ঞান নির্ভর বিষয়। পিতামাতা কর্তৃক সন্তানদেরকে যতবেশি তথ্য ও টেক্স গিলানো যায় এর সাথে তারবিয়া সম্পৃক্ত। এর সাথে পিতামাতাকে তারবিয়া দানের পদ্ধতি সম্পর্কে লেখা হয়েছে এমন বিশাল সংখ্যক বই-পুস্তক ও গবেষণাপত্র সংগ্রহ করার চেষ্টা করতে হবে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, তারা শরয়ি দলিলগুলোর কর্মগত শিক্ষা (তারবিয়া আমলী) কে বাদ দিয়ে দলিলগুলোর মস্তিষ্কপ্রসুত বিভিন্ন তত্ত্বীয় ব্যাখ্যা খুঁজে বেড়াচ্ছেন। এর একটি উদাহরণ হচ্ছে-
আল্লাহ্র বাণী: “আল্লাহ্কে তারাই ভয় করেন; আল্লাহ্র বান্দাদের মধ্যে যারা জ্ঞানী”[সূরা ফাতির; আয়াত নং- ২৮] কে তারা শরয়ি হুকুম-আহকামে পারদর্শী আলেম ও বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্টাল জ্ঞানে পারদর্শী বিজ্ঞানী উভয়ের ব্যাপারে গ্রহণ করেন। অথচ আয়াতে কারীমাতে এমন প্রমাণ নেই যে, প্রত্যেক জ্ঞানীই আল্লাহ্কে ভয় করেন। বরং আয়াতটি প্রমাণ করছে, যে ব্যক্তি আল্লাহ্কে ভয় করে সেই জ্ঞানী।
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া বলেন: আল্লাহ্ তাআলা বলেন, “আল্লাহ্কে তারাই ভয় করেন; আল্লাহ্র বান্দাদের মধ্যে যারা জ্ঞানী”[সূরা ফাতির, আয়াত: ২৮] এ বাণীটি প্রমাণ করছে যে, যে ব্যক্তি আল্লাহ্কে ভয় করে সেই জ্ঞানী। এ ব্যাখ্যাই সঠিক। এ বাণীটি এ কথা প্রমাণ করে না যে, প্রত্যেক জ্ঞানী ব্যক্তিই আল্লাহ্কে ভয় করে।”[মাজমুউল ফাতাওয়া (৭/৫৩৯) থেকে সমাপ্ত]
তিনি অন্য এক স্থানে (৭/২১) বলেন:
আয়াতের অর্থ হচ্ছে- আল্লাহ্কে কেউ ভয় করে না; তবে আলেমরা ছাড়া। অর্থাৎ আল্লাহ্ তাআলা জানাচ্ছেন যে, যে ব্যক্তি আল্লাহ্কে ভয় করে সেই আলেম। যেমনটি অন্য আয়াতেও বলেছেন: “যে ব্যক্তি রাতের বিভিন্ন প্রহরে সিজদাবনত হয়ে ও দাঁড়িয়ে আনুগত্য প্রকাশ করে, আখিরাতকে ভয় করে এবং তার রবের অনুগ্রহ প্রত্যাশা করে, (সে কি তার সমান, যে তা করে না?) বলুন, ‘যারা জানে এবং যারা জানে না; তারা কি সমান?’[সূরা যুমার, আয়াত: ০৯][সমাপ্ত]
শাইখুল ইসলাম যে আয়াতটির দিকে ইঙ্গিত করেছেন সেটিকেও এর প্রকৃত অর্থের পরিবর্তে ভিন্নার্থে ব্যাখ্যা করা হয়। আমল ও তারবিয়া বিহীন জ্ঞান ও শিক্ষার প্রশংসার পক্ষে দলিল হিসেবে আয়াতটিকে পেশ করা হয়। এ ক্ষেত্রে তারা আয়াতটির প্রথমাংশের পরিবর্তে শুধু শেষাংশ উল্লেখ করেন। অথচ আয়াতটির শেষাংশ “যারা জানে এবং যারা জানে না; তারা কি সমান?” এর তাফসির রয়েছে আয়াতের প্রথমাংশে “যে ব্যক্তি রাতের বিভিন্ন প্রহরে সিজদাবনত হয়ে ও দাঁড়িয়ে আনুগত্য প্রকাশ করে, আখিরাতকে ভয় করে এবং তার রবের অনুগ্রহ প্রত্যাশা করে, (সে কি তার সমান, যে তা করে না?)”। আয়াতের শেষাংশে যাদেরকে জ্ঞানী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে আয়াতের প্রথমাংশে তাদেরকে জান্নাত ও আল্লাহ্র রহমতের আশাপ্রার্থী হয়ে, জাহান্নামের ভয়ে ভীত হয়ে রাতের প্রহরসমূহে বিনয়াবনত হয়ে নামায আদায়কারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আর যাদেরকে জ্ঞানহীন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে তারা এ সকল আমল সম্পর্কে গাফেল। এভাবে বিষয়টি একটু ভেবে দেখুন।
এ কারণে ইবনুল কাইয়্যেম ‘মিফতাহুস সাআদা’ গ্রন্থে (১/৮৯) একটি মূলনীতি নির্ণয়ন করতে গিয়ে বলেন: “সলফে সালেহীনগণ শুধু সেসব ইল্মকে ফিকাহ বলতেন যেসব ইলমের সাথে আমল পাওয়া যেত”[সমাপ্ত]
আমাদের সলফে সালেহীনদের নিকট এটাই হচ্ছে ফিকাহের স্বরূপ; অর্থাৎ ইলমের সাথে আমল। এই হাকীকত যখন অনেক দাঈ, শিক্ষক ও প্রতিপালকদের মাথা থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায় তখন তারা মানুষের চরিত্র ঠিক করার পরিবর্তে, অন্তরকে সংশোধন করার পরিবর্তে, আত্মার পরিচর্যার বদলে, আখলাককে পরিশীলিত করার বিপরীতে তাত্ত্বিক মস্তিষ্কনির্ভর তারবিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়েন। তারা ভাবেন, এটাই হচ্ছে- ঈপ্সিত তারবিয়া, কাঙ্ক্ষিত ফিকাহ; কিন্তু আসলে ব্যাপারটি এমন নয়।
চরিত্র ও দ্বীনদারি শিক্ষা দান রব্বানী (আল্লাহ্প্রিয়) লোকদের ছাড়া সম্ভবপর নয়। চাই তারা আলেম হন, দাঈ হন, সংস্কারক হন কিংবা শিক্ষক হন। রব্বানী হচ্ছেন তিনি যিনি ইল্ম, আমল ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে রব্ব এর সাথে সম্পৃক্ত থাকেন।